স্বদেশ ডেস্ক:
শিক্ষার্থীদের হাফ পাসের (অর্ধেক ভাড়া) দাবি এখন পর্যন্ত মানতে রাজি হননি বাসমালিক ও শ্রমিকরা। এমনকি সরকারের তরফ থেকে এ ধরনের সিদ্ধান্ত এলে যান চলাচল বন্ধ রাখার আভাসও দিয়ে রেখেছেন তারা। অন্যদিকে শিক্ষার্থীরাও জানিয়ে দিয়েছেন, দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত তারা রাজপথ ছাড়বেন না। গতকালও রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে অবস্থান নেন তারা।
হাফ পাসের দাবিতে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে ১৫ নভেম্বর। এর পর দুই সপ্তাহ ধরে আন্দোলন চলছে। শিক্ষার্থীদের এই দাবি নিয়ে দুই দফায় বাসমালিক-শ্রমিকদের সঙ্গে বৈঠকে বসে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। তবে উভয়পক্ষ কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেনি।
গত শনিবার দ্বিতীয় দফার বৈঠকের পর ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলে বসেন, ‘ঢাকায় চলাচলকারী পরিবহন মালিকদের ৮০ শতাংশ গরিব।’ তার এই বক্তব্য নিয়ে আলাচনা-সমালোচনা শুরু হয়।
এ অবস্থায় গতকাল বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার ৩০ জনের কাছে এনায়েত উল্যাহর মন্তব্যের ব্যাপারে মতামত চাওয়া হয়। এদের মধ্যে ৯৫ শতাংশ মানুষ মনে করেন, এনায়েত উল্যাহর বক্তব্য বিশ্বাসযোগ্য নয়। ৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন, তিনি সঠিক কথা বলেছেন।
বাকি ১ শতাংশ মানুষ এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি।
যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘হাফ ভাড়ার যৌক্তিক দাবি মানা উচিত। পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা বহুবার নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায়ে অনৈতিকভাবে সরকারকে চাপে রাখতে ধর্মঘট পালন করেছে। যেভাবে ভাড়া বাড়ানো হয়েছে, সেটি গলার কাঁটার মতো।’
যাত্রীরা বলছেন, চাঁদাবাজি বন্ধ হলে, পরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরলে প্রতিটি বাসে ৫-৭ জন শিক্ষার্থীকে অর্ধেক ভাড়ায় বহন করলেও মালিকদের কোনো লোকসান হবে না। বাসমালিক তথা পরিবহন নেতাদের প্রভাব বেশি। তারা সরকার সমর্থিত পরিচয়ে কর্তৃপক্ষের ওপর প্রভাব খাটান। তাই সরকারের নীতিনির্ধারণী বৈঠকে তাদের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে।
যাত্রীরা বলছেন, আইন অনুসারে বড় বাসে আসন থাকবে ৫২টি, মিনিবাসে ৩০টি। সামনে-পেছনের দুটি আসনের দূরত্ব হবে ২৬ ইঞ্চি। কিন্তু পরিবহন মালিকরা ইচ্ছেমতো আসন বসিয়েছেন। ফলে যাত্রীরা পা সোজা করে বসতে পারেন না।
যাত্রীদের দাবি মানতে পরিবহন নেতাদের যত অনীহা, নিজেদের দাবি আদায়ে তারা ঠিক ততটাই কট্টর। পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের দাবি মেনে এরই মধ্যে সড়ক পরিবহন আইনের কয়েক ধারা সংশোধনও করা হয়েছে। সড়ক আইনের সবচেয়ে কঠোর ধারা ছিল ৮৪, ৯৮ ও ১০৫। এগুলো অজামিনযোগ্য অপরাধ। কিন্তু এবারের সংশোধনে ৮৪ ও ৯৮ ধারা জামিনযোগ্য করার সুপারিশ এসেছে। এমনকি ৯৮ ধারার অপরাধকে আপসযোগ্য করার কথা বলা হয়েছে। ১০৫ ধারায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানির দায়ে সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদ- বা পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দ-ের বিধান রয়েছে। কিন্তু সংশোধনের সুপারিশে কারাদ- পাঁচ বছর রেখে জরিমানা কমিয়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
নানা কৌশলে মালিকরা ভাড়াও বাড়িয়েছেন দফায় দফায়। যদিও ভাড়া নির্ধারণের ব্যয় বিশ্লেষণে শুভঙ্করের ফাঁকি রয়েছে। ভাড়া নির্ধারণের ব্যয় বিশ্লেষণে পুরনো বাসকে নতুন বাস হিসেবে দেখানো হয়েছে। চালক-হেলপারদের বেতন-বোনাস দেওয়ার মিথ্যা তথ্য তুলে ধরেছে মালিকপক্ষ। ২০ বছর আগে কেনা বাসেও ব্যাংক লোন দেখানো হয়েছে। এভাবে নানা খাতে অযৌক্তিক ও অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি দেখিয়ে একলাফে কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৪২ পয়সার ভাড়া ১ টাকা ৮০ পয়সা করা হয়েছে। সঠিক ব্যয় বিশ্লেষণ করলে সর্বোচ্চ ১ টাকা ৬০ পয়সা নির্ধারণ করা যেত।
পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঢাকার বাসে বছরে একবারের বেশি টায়ার বদল করা হয় না। একাধিক মালিক বলেছেন, দাম বেড়ে যাওয়ায় টায়ার ‘রিট্রেডিং’ বা ক্ষয় হয়ে যাওয়ার পর ওপরে প্রলেপ দিয়ে চালানো হয়। বছরে ১ লাখ ২০ হাজার টাকার বেশি টায়ারে খরচ হয় না।
ব্যয় বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ৩৫ লাখ টাকার একটি বাস ঢাকায় ১০ বছর চলে। ৭৫ লাখ টাকার বাস মহাসড়কে একই সময় চলে। এ অংকেও ভুল বলছেন পরিবহন খাতসংশ্লিষ্টরা। ব্যয় বিশ্লেষণের হিসাবে বাসের বিনিয়োগ হিসেবে প্রতি কিলোমিটারে ১০ টাকা ৭৭ পয়সা খরচ হয়। দূরপাল্লায় এ খরচ ১০ টাকা ১৫ পয়সা। ৫২ আসন ধরে হিসাব করা হলেও দূরপাল্লার অধিকাংশ বাসে আসন ৪০টি। আসন কমায় ভাড়াও সেই অনুপাতে বাড়বে। এ রকম নানা বিবেচনায় বাসে ছাত্রছাত্রীদের জন্য হাফ ভাড়া করা যেতেই পারে। এ জন্য ভর্তুকির প্রয়োজন নেই।